বিজ্ঞানের জন্য

জেলেরা গত রাত থেকে ইলিশ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। সমুদ্রগামী জেলেদের সকল প্রস্তুতি আগেভাগেই সম্পন্ন করা ছিলো। রাত বারোটা বাজার সাথে সাথে ট্রলার নিয়ে তারা সাগরে যাত্রা করছেন। আর স্থানীয় জেলেরাও জাল পাতছেন পদ্মা ও মেঘনা নদীতে।

নিরাপদ প্রজনন ও বংশ বিস্তার নির্বিঘ্ন করতে উপকূলীয় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারে সব ধরনের মৎস্য এবং সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিপণনে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে গত মধ্যরাতে। গত ১৩ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছিল। উপকূলীয় এলাকায় মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জেলেরা। ঝিমিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চলের জেলে পল্লী ও মাছের মোকামে চাঞ্চল্য ফিরতে শুরু করেছে। এবার নিষেধাজ্ঞাকালে জেলা প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় মৎস্য অধিদফতর ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে। তবে জেলে ও মৎস্যজীবীদের আইন ভাঙার প্রবণতাও তুলনামূলক বেশি ছিল।

নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড ইলিশ আহরণ বন্ধে মৎস্য অধিদফতর ও প্রশাসনের সাথে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মৎস্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞাকালে প্রায় ২০ হাজার অভিযান ও আড়াই হাজার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় বেআইনিভাবে আহরিত প্রায় ৪২ হাজার টন ইলিশ ও আরো প্রায় ৮ হাজার টন অন্যান্য মাছ জব্দ করা হয়। জব্দকৃত মাছের বেশিরভাগই বিভিন্ন এতিমখানা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করে প্রশাসন। এসময়ে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার জেলেকে এক মাস থেকে ৩ বছর পর্যন্ত করাদন্ডাদেশ ও প্রায় ৮২ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসব অভিযানে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মিটার কারেন্ট জাল ও প্রায় ২২০০ মিটার নিষিদ্ধ উপকরণ বাজেয়াপ্ত করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। যার দাম প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ বলে জানা গেছে। এছাড়াও মৎস্য বিভাগ অভিযানকালে সাড়ে ৬ হাজারেরও বেশি মামলা দায়ের করেছে। অভিযানে আটক নৌকা ও বিভিন্ন উপকরণ নিলামে বিক্রি করে সরকারের প্রায় ১৯ লাখ টাকা আয় হয়েছে। মৎস্য বিভাগের এসব অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমের বেশিরভাগই ছিল বরিশালের অভ্যন্তরীণ ও উপক‚লীয় নদ-নদীসহ সাগর মোহনায়। দেশে উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৭০ ভাগই বরিশাল বিভাগে আহরিত হয়। গত দুই দশকে বরিশাল বিভাগে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১৫০%-এরও বেশি।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের ইকোসিস্টেমে সারা বছরই ৩০% ইলিশ ডিম বহন করে। এসব ইলিশ পরিপক্ক হয়ে ডিম ছাড়ে। যে ডিমগুলো পুরুষ ইলিশ দ্বারা নিষিক্ত হয়ে থাকে তা এ মাছের নতুন প্রজন্ম গঠন করে। আর আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে-পরে ভোলার পশ্চিম আউলিয়া পয়েন্ট-তজুমদ্দিন, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লতাচাপলি পয়েন্ট-এর ধলচর দ্বীপ, মনপুরা দ্বীপ, মৌলভীরচর দ্বীপ ও কালিরচর দ্বীপ, মায়ানী পয়েন্ট-মীরসরাই ও কুতুবদিয়া পয়েন্ট এলাকায় মা ইলিশের প্রাচুর্য থাকায় ওইসব এলাকার ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারে গত ২২ দিন সবধরনের মৎস্য আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।

মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্তভাবে ভাসমান ডিম থেকে ফুটে বের হবার পরে ইলিশের লার্ভা স্বাদু ও নোনা পানির নার্সারি ক্ষেত্রসমূহে বিচরণ করে। পরিপক্কতা অর্জনের লক্ষ্যে নার্সারি ক্ষেত্রসমূহে ৭-১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে জাটকা হিসেবে সমুদ্রে চলে যায়। এসব জাটকা বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২-১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্কতা অর্জন করে আবার স্বাদু পানির নার্সারি ক্ষেত্রে ফিরে আসে।

ইলিশ আহরণে বিরত জেলেদের জন্য খাদ্য সহায়তা হিসেবে সরকার ১৫২টি উপজেলার ৫ লাখ ২৮ হাজার ৩৮২ জেলে পরিবারে ২০ কেজি করে ১০ হাজার ৫৬৬ টন চাল বিতরণ করেছে। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের ২ লাখ ৮২ হাজার ৫শ’ জেলে পরিবারের মধ্যে ৫ হাজার ৬৫০ টন চাল বিতরণ করা হয়।

গত দুই দশকে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন সোয়া দুই লাখ টন থেকে গত বছর ৫ লাখ ৩৩ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরে ৫ লাখ ৪০ হাজার টনে ও আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৫ লাখ টনে উন্নীত হবার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে মৎস্য অধিদফতর।

‘হিলসা ফিসারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্লান’-এর আওতায় ২০০৫ সালে প্রথম প্রধান প্রজনন মৌসুমে ১০ দিন ইলিশের আহরণ বন্ধ রাখা হয়। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে ২০১১ সালে তা ১১, ২০১৫ সালে ১৫ ও ২০১৬ সাল থেকে ২২ দিন বন্ধ রাখা হয়। অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এরও বেশি। আর মৎস্য খাতে অবদান প্রায় ১২%। সারা বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৬০% বাংলাদেশে উৎপাদন ও আহরিত হচ্ছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post