বিজ্ঞানের জন্য

ফিতরা বা ফেতরা (فطرة) আরবী শব্দ, যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয় যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ করেন। যাকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরীব দুঃস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে। রোজা বা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা খাদ্য গ্রহন করা হয়। সেজন্য রমজান মাস শেষে এই দানকে যাকাতুল ফিতর  আহারের যাকাত বলা হয়।
ফিতরা আদায়- প্রতীকী ছবি 
নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন, শিশু-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের জন্য ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব। ইবনে উমর (রাঃ) থেকে জানা যায়ঃ

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক স্বাধীন-ক্রিতদাস, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় মুসলমানের যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এক ‘সা’ পরিমাণ খেজুর বা যব। তিনি লোকদেরকে ঈদের নামাযে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন।”

∎∎ ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। ফিতরা দেয়ার সামর্থ্য আছে (একদিন ও এক রাতের খাদ্যের অতিরিক্ত পরিমাণ সম্পদ থাকলে) এরকম প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের ও পরিবারের সমস্ত সদস্যদের পক্ষ থেকে ফিতরা প্রদান করা ফরজ, যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব শরীয়ত কর্তৃক তার উপরে অর্পিত হয়েছে। নাবালক ছেলেমেয়ের পক্ষ থেকে তাদের বাবাকে এই ফিতরা দিতে হয়। আর তা দিতে হয় ঈদুল ফিতরের নামাজের আগেই।

যার নিকট এক দুই বেলার খাবার ব্যতীত অন্য কিছু অবশিষ্ট নেই তার ফিতরা দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। সাধারন ভাবে গরীব, দুঃস্থ, অসহায় ও অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিকে ফিতরা প্রদান করা যাবে। উল্লেখ্য যে, নিজের বেতনভুক্ত কাজের ব্যক্তি বা কর্মচারির পক্ষে ফিতরা প্রদান করা মালিকের উপর আবশ্যক নয়। তবে মালিক ইচ্ছে করলে নিজের কাজের লোককে ফিতরা প্রদান করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি বেতন বা পারিশ্রমিক হিসেবে ফিতরা প্রদান করতে পারবেন না।

আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) বলেন:
“আমরা-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যাকাতুল ফিতর বের করতাম এক সা খাদ্য দ্রব্য কিংবা এক সা যব কিংবা এক সা খেজুর কিংবা এক সা পনীর কিংবা এক সা কিশমিশ এর মাধ্যমে”।

∎∎ এই হাদীসে খেজুর ও যব ছাড়া আরও যে কয়েকটি বস্তুর নাম পাওয়া গেল তা হল; কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য। উল্লেখ থাকে যে, নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তেকালের পরে হযরত মুআবীয়া (রাযিঃ)-এর খেলাফতে অনেকে গম দ্বারাও ফিতরা আদায় করতেন। সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) এর বর্ণিত হাদিস থেকে খাদ্য দ্রব্য দিয়ে ফিতরা প্রদানের কথাও জানা যায়। যেহেতু চাল বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান খাদ্য, সেহেতু চাল দিয়েও ফিতরা প্রদান করা যাবে। চালের বদলে ধান দিয়ে ফিতরা দিতে হলে, ওজনের ব্যাপারটা সবথেকে বেশি মাথায় রাখতে হবে। কারণ এক সা ধান কখনো এক সা চালের সম মূল্যের হবে না। কুরআন থেকে জানা যায়ঃ

“তোমরা খাদ্যের খবিস (নিকৃষ্ট) অংশ দ্বারা আল্লাহর পথে খরচ করার সংকল্প করিও না। অথচ তোমরা স্বয়ং উহা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত নও।” (আল-কোরআন)

তবে ধানের থেকে চাল দিয়ে ফিতরা প্রদান করা উত্তম। নিম্নোক্ত কিয়াস থেকে এই ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়ঃ যবের উপর কেয়াস (অনুমান) খাটাইয়া ধানের ফিতরা জায়েয হইবে না, কারণ ধান আদৌ আহার্য সামগ্রী নয়। উপমহাদেশীয়দের জন্য এক সা চাউল দিতে হইবে এবং ফিতরা আদায়ে তাহাই উত্তম।

মুহাম্মদ (সঃ) এর যুগে মুদ্রা হিসেবে দিরহাম প্রচলিত ছিলো। দিরহামের দ্বারা কেনা কাটা, দান খয়রাত করা হতো। তবু সাহাবী খুদরী (রাযিঃ) এর বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) খাদ্য বস্তু দিয়েই ফিতরা প্রদান করতেন। এজন্য মুসলমান পন্ডিতদের বড় অংশ টাকা দিয়ে ফিতরা প্রদানের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষন করেন। ইমাম আহমদ (রঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের বরখেলাফ হওয়ার কারণে আমার আশংকা হচ্ছে যে, তা যথেষ্ট হবে না।

তবে প্রয়োজনে টাকা দিয়েও ফিতরা আদায় করা বৈধ। বাংলাদেশের মুসলিমগণ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে চাইলে ২.৪০ (দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম) মধ্য মানের চাউলের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। অবশ্য বাংলাদেশ যাকাত বোর্ড প্রতিবছর শহর ও গ্রাম এলাকার জন্য ফিতরার মূল্য নির্ধারণ করে দেন। তবে সম্ভব হলে খাদ্যবস্তু দিয়ে ফিতরা প্রদান করা উচিত।

∎∎  ফিতরা প্রদানের পরিমাপ সংক্রান্ত আলোচনায় ‘সা’ বহুল আলোচিত একটি শব্দ। সা হচ্ছে আরবদেশে ওজন বা পরিমাপে ব্যবহৃত পাত্র। বাংলাদেশে যেমন ধান পরিমাপের জন্য একসময় কাঠা ব্যবহৃত হত তেমনি! একজন মাঝামাঝি শারীরিক গঠনের মানুষ অর্থাৎ অধিক লম্বা নয় এবং বেঁটেও নয়, এই রকম মানুষ তার দুই হাত একত্রে করলে যে অঞ্জলি গঠিত হয়, ঐরকম পূর্ণ চার অঞ্জলি সমান হচ্ছে এক ‘সা’।

হাদিস থেকে সুস্পষ্ট জানা যায়, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কতৃক এক সা পরিমাণ ফিতরা প্রদানের কথা। মুহাম্মদ (সঃ) এবং চার খলিফার মৃত্যুর পরে মুআবিয়া (রাঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা নির্বাচিত হন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদিনা থেকে দামেস্ক স্থানান্তরিত করেন, তখন তারা গমের সাথে পরিচিত হন। সে কালে সিরিয়ার গমের মূল্য খেঁজুরের দ্বিগুণ ছিল। তাই খলিফা মুয়াবিয়া একদা হজ্জ বা উমরা করার সময় মদীনায় আসলে মসজিদের মিম্বরে দাড়িয়ে বলেন; আমি অর্ধ সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য মনে করি। লোকেরা তার এই কথা মেনে নেয়। এর পর থেকে মুসলিম জনগনের মধ্যে অর্ধ সা ফিতরার প্রচলন শুরু হয়।

∎∎ ফিতরার ক্ষেত্রে ওয়াজিব হচ্ছে-এক স্বা‘খাদ্য প্রদান করা।যে স্বা‘ বা পাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যবহার করেছেন সে স্বা অনুযায়ী। সাধারণ মাপের দুই হাতের পরিপূর্ণ চার মুষ্ঠি এক স্বাকে পূর্ণ করে। যেমনটি আলক্বামূস ও অন্যান্য আরবী অভিধানে উল্লেখ করা হয়েছে।মেট্রিক পদ্ধতির ওজনে এর পরিমাণ প্রায় ৩ কিলোগ্রাম। যদি কোন মুসলিম চাউল বা দেশীয় কোন খাদ্যদ্রব্যের এক স্বা‘ দিয়ে ফিতরা আদায় করেন তবে তা জায়েয হবে; যদিওবা সে খাদ্যের কথা এই হাদিসে সরাসরি উল্লেখ না করা হয়ে থাকে। এটাই আলেমগণের দুইটি মতের মধ্যে বেশি শক্তিশালী। আর মেট্রিক পদ্ধতির ওজনের হিসাবে প্রায় ৩ কিলোগ্রাম দিলেও চলবে।

ছোট-বড়,নারী-পুরুষ, স্বাধীন-ক্রীতদাস সকল মুসলিমের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। কিন্তু গর্ভস্থিত সন্তানের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয় মর্মে আলেমগণের ইজমা (ঐকমত্য) সংঘটিত হয়েছে। তবে তার পক্ষ থেকেও আদায় করা হলে সেটা মুস্তাহাব। কারণ উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এ ধরনের আমল সাব্যস্ত আছে।
ফিতরার খাদ্য ঈদের নামাযের আগেই বন্টন করা ওয়াজিব। ঈদের নামাযের পর পর্যন্ত দেরি করা জায়েয নয়। বরঞ্চ ঈদের এক বা দুই দিন আগে আদায় করে দিলে কোন অসুবিধা নেই। এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জানা গেল যে, আলেমদের বিশুদ্ধ মতানুযায়ী ফিতরা আদায় করার সময় শুরু হয়২৮ শে রমজান। কারণ রমজান মাস ২৯ দিনও হতে পারে। আবার ৩০ দিনও হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ ফিতরা ঈদের একদিন বা দুই দিন আগে আদায় করতেন।ফিতরা প্রদান করার খাত হচ্ছে- ফকিরও মিসকীন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন:

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনর্থক কাজ ও অশ্লীলতা হতে পবিত্রকরণ এবং মিসকীনদের জন্য খাদ্যের উৎস হিসেবে রোযাপালনকারীর উপর ফিতরা ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি ঈদের সালাতেরআগে তা আদায়ক রবে তা কবুল যোগ্য ফিতরা হিসেবে গণ্য হবে।আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পর আদায় করবে সেটা সাধারণ সদকা হিসেবে গণ্যহবে।” [সুনানে আবুদাউদ (১৬০৯) এবং আলবানী এ হাদিসটিকে সহীহ আবুদাউদ গ্রন্থে ‘হাসান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন]

অধিকাংশ আলেমের মতে খাদ্যের বদলে খাদ্যের মূল্য দিয়ে ফিতরা আদায় করলে তা আদায় হবে না। দলীলের দিক থেকে এই মতটি অধিক শুদ্ধ। বরং ওয়াজিব হলো খাদ্যদ্রব্য থেকে ফিতরা আদায় করা। যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ আদায় করেছেন। উম্মতের অধিকাংশ আলেম এ মতের পক্ষ অবলম্বন করেছেন। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যাতে তিনি আমাদেরকে ও সকল মুসলমানকে তাঁর দ্বীনের ফিকাহ (প্রজ্ঞা) দান করেন, এর উপর অটল অবিচল থাকার তাওফিক দেন, আমাদের অন্তরসমূহ ও কাজকর্মকে পরিশুদ্ধ করে দেন। তিনি তো মহামহিম, পরম করুণাময়।”  সমাপ্ত [মাজমু ফাতাওয়া ইবনে বায (বিন বাযের ফতোয়া সংকলন) (১৪/২০০)]

শাইখ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ এর মতে কিলোগ্রামের হিসাবে ফিতরার পরিমাণ প্রায় ৩ কিলোগ্রাম। ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির আলেমগণও একই পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। (৯/৩৭১)

শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ চাউল দিয়ে ফিতরা দেয়ার পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন ২১০০ গ্রাম (অর্থাৎ ২.১কিলোগ্রাম) [ফাতাওয়ায যাকাত (যাকাত বিষয়ক ফতোয়া সংকলন), পৃষ্ঠা: ২৭৪-২৭৬]

ওজন নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই মতভেদের কারণ হল স্বা' হচ্ছে- পরিমাপের একক, ওজনের একক নয়।

এজন্য ফিতরা প্রদানের এক সা এর পরিবর্তে  আলেমগণ ওজন দ্বারা হিসাব নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন কারণ সেটা হিসাব রাখার ক্ষেত্রে বেশি সহজ ও সুক্ষ্ম। এ কথা সবাই জানে যে, একেক শস্যদানার ওজন একেক রকম। এর মধ্যে কোনটি হালকা, কোনটি ভারী এবং কোনটি মাঝারি ওজনের। বরঞ্চ একজাতীয় শস্যদানার ওজনও বিভিন্ন হয়ে থাকে। নতুন ফসলের ওজন পুরাতন ফসলের চেয়ে বেশি। তাই সতকর্তাবশতঃ কেউ যদি কিছুটা বেশি আদায় করে তবে সেটা বেশি নিরাপদ ও উত্তম।
[বিস্তারিত- আল-মুগনী’ গ্রন্থেরখণ্ড- ৪, পৃষ্ঠা- ১৬৮]
সেখানে ফসলের যাকাতের নিসাব উল্লেখ করতে গিয়ে ওজনের এই হার উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

মূল থত্যসূত্র-
ফতোয়া নং ৫৭৩৩ খণ্ড ৯য় পৃ: ৩৬৫; মুসলিম, অধ্যায়: যাকাত,
অনুচ্ছেদ: এবং যাকাতুল ফিতর হাদীস নং ২২৮১ এবং ৮২।
(নোট-লেখাটি নবীজী.কম সাইট থেকে নেয়া হয়েছে)

Post a Comment

Previous Post Next Post