ঐতিহ্যের ধারায় সংগঠনকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজ করছেন ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্ব। সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সংগঠনের লাখো সাধারণ কর্মীর পাশাপাশি গোটা দেশবাসীরও প্রত্যাশা এটাই। সবাই চাইছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই-সংগ্রাম আর ছাত্রসমাজের কল্যাণে কাজ করার পুরোনো সেই ঐতিহ্যের ধারায় ফিরে আসুক। পূরণ করুক জনমানুষের বিশাল আকাঙ্ক্ষাও।
এমন প্রেক্ষাপটেই আজ সোমবার পালিত হচ্ছে দেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জাতির পিতা সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতো এবারও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে রেখে প্রশ্ন উঠেছে, এই দীর্ঘ যাত্রাপথ পেরিয়ে আসা বর্তমান ছাত্রলীগ কি সঠিক পথে আছে?
জবাবে অনেকেই বলছেন, যে প্রত্যাশা নিয়ে সংগঠনের 'সাংগঠনিক নেত্রী' প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতৃত্ব বাদ দিয়ে নতুন কাণ্ডারি ঠিক করে দিয়েছিলেন- তার কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে। বিশেষ করে চলমান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে মানুষের পাশে থেকে ও তাদের কল্যাণে কাজ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশ কিছুটা হলেও পালন করেছেন ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্ব।
অন্যদিকে এই সময়কালে টেন্ডার-চাঁদাবাজিসহ 'প্রভাব বিস্তারের' অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সন্ত্রাস, অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনির ধারাও অনেকটা অনুপস্থিত ছিল। বরং দুর্নীতি-অনিয়ম, চাঁদাবাজি এবং দ্বন্দ্ব-কোন্দলে লিপ্ত অনেকের বিরুদ্ধেই বহিস্কারসহ কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছাত্রলীগের ললাটে যে কলঙ্কের তিলকরেখা অঙ্কিত হয়েছিল, তার কিছুটা হলেও অবসান ঘটেছে। রাজনৈতিক বিশ্নেষকরাও এমনটাই মনে করছেন।
অবশ্য সংগঠনের বর্তমান নেতাদের বিরুদ্ধেও কিছু অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বড় অভিযোগ হচ্ছে, দায়িত্ব পালনের প্রায় সোয়া বছরে মাত্র পাঁচটি জেলা কমিটি দিতে পেরেছেন তারা। সেটিও আবার সম্মেলন করে নয়, প্রেস রিলিজের মাধ্যমে। অনেক পদপ্রত্যাশীর অভিযোগ, জেলা কমিটিতে যোগ্যতার চেয়ে নেতাদের পছন্দকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কমিটি দেওয়ার বেলায় 'অর্থ লেনদেনের' অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া কমিটি গঠন নিয়ে কিছুটা হলেও দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।
ছাত্রলীগের দেশব্যাপী ১১১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ১০৪টিই মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও ওইসব জেলার সম্মেলন অথবা কমিটি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন শীর্ষ নেতারা। আবার তৃণমূল থেকে কমিটি চাওয়া হলে 'নেত্রীর নির্দেশ পেলেই কমিটি দিয়ে দেবো'- এমন কথা বলে এড়িয়েও যাওয়া হচ্ছে। এভাবে পুরোনো কমিটি দিয়েই জেলা-উপজেলা ছাত্রলীগ চলছে। এতে ক্ষোভে-হতাশায় সম্ভাবনাময় অনেক তরুণ নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছেন।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ১১টি কমিটি দিয়েছেন তারা। এতে কোনো অনিয়ম হয়নি। যে কমিটিই দেওয়া হচ্ছে, তাদের দু'জনের (সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) মতামতেই হচ্ছে। বাকি জেলা কমিটিগুলোও শিগগিরই দেওয়া হবে বলেও দাবি তার।
ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান বলেন, ছাত্রলীগ জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনার সময়ও সারাদেশের নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রলীগের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য সমুন্নত রেখেই কাজ করে যাচ্ছেন তারা। আর ছাত্রলীগের এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাদের অঙ্গীকারই হচ্ছে- গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাওয়া।
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস :তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রভাষা 'উর্দু'র বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রলীগের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে সংগঠনটির নাম ছিল 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ'। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামে কার্যক্রম শুরু করে।
বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনই ছিল ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য। প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে নামেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এরপর থেকে '৫২-র ভাষা আন্দোলন, '৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, এগারো দফা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং '৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির পতাকাবাহী এ সংগঠনের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয় ও গৌরবোজ্জ্বল। এসব আন্দোলন-সংগ্রামে সংগঠনের অগণিত নেতাকর্মী শহীদও হয়েছেন।
অবশ্য রাজনীতির নানা সমীকরণে বিভক্তির ধারায় ছাত্রলীগের কয়েকটি অংশ এখন সক্রিয়। আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মূল ধারার সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। ১৯৭২ সালে জাসদের সহযোগী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ) দলীয় বিভক্তির কারণে বর্তমানে তিনটি পৃথক ধারায় ছাত্রলীগ নাম নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ ছাড়া ছাত্রলীগ (অদলীয়) নামের আরও একটি অংশ সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি :ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আজ সংগঠনের সবক'টি অংশ পৃথক কর্মসূচি পালন করবে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে রয়েছে সকাল সাড়ে ৭টায় সংগঠন কার্যালয়ে জাতীয় ও সংগঠনের পতাকা উত্তোলন, ৮টায় ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে কেক কাটা, ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, ফাতেহা পাঠ ও দোয়া মাহফিলে অংশগ্রহণ এবং বিকেল ৪টায় রাজধানীর খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এছাড়া আগামী ৬ জানুয়ারি সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ এবং ৮ জানুয়ারি সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা সংলগ্ন বটতলায় স্বেছায় রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন করা হবে।
ছাত্রলীগ (জাসদ) আজ সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় সমাবেশ ও শোভাযাত্রা করবে। এছাড়া বাংলাদেশ জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বিসিএল) আজ দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়কদ্বীপে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান ও সংগঠনের ২৯তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের আয়োজন করবে।
Post a Comment