আজ পয়লা আষাঢ়
কদিন ধরেই আকাশ ক্ষণে ক্ষণে মেঘলা। এই বৃষ্টি, এই রোদ। মেঘ আর রোদের এই লুকোচুরির মধ্যেই এসে গেল বর্ষা। আজ পয়লা আষাঢ়। এবার আষাঢ় এল অনেকটা চুপিসারে, অনাড়ম্বরে। ঘটা করে বর্ষাবরণ নেই। চোখ তুলে মেঘমেদুর আকাশ দেখার মন কোথায়? মনের ভেতর ঘাপটি মেরেছে করোনার ভয়। ঘরের বাইরে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে কোভিড–১৯। কিন্তু সকল কাঁটা ধন্য করে আপন মাধুর্যে প্রকৃতির সন্তানদের বুকে তুলে নেওয়ায় মৌসুমি ঋতুর কাজ। তাই আকাশভরা বৃষ্টি নিয়ে আষাঢ় এসেছে। বাদলের ধারায় এই ধরা থেকে ধুয়েমুছে নেবে সব জরা।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষা খুব, খুবই উল্লেখযোগ্য। বছর ঘুরে আবারও এসেছে বর্ষণমুখর দিন। এরই মাঝে বদলাতে শুরু করেছে প্রকৃতি। এতদিনের রুক্ষ শুষ্ক প্রকৃতি বৃষ্টির জলে ধুয়ে সবুজ সতেজ হচ্ছে। উর্বর হচ্ছে ফসলের মাঠ। কবিগুরুর ভাষায়: তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে-/মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা...। বর্ষাকে স্বাগত জানিয়ে নজরুল লিখেছেন: রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে।/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে...। ভাটি বাংলার সাধক উকিল মুন্সি ঘাটে নতুন পানি দেখে উতলা হয়ে গেয়েছিলেন: যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখি রে/অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে...। বাঙালীর হৃদয়ে জমে থাকা কথা বর্ষায় ভাষা পায়। মন জাগিয়ে দিতে, আবেগ ভালবাসায় ভরিয়ে দিতে আসে বর্ষা। এবারও এসেছে।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে অনেক কিছুই আর আগের মতো নেই। বর্ষাও দিন ক্ষণ অতো মানে না। অনেক দিন আগে থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। ঝড়ো হাওয়া ভারি বর্ষণ মূলত আভাস দিচ্ছলÑ বর্ষা আসছে। আর প্রকৃত শুরু আজ থেকে। ঋতুর হিসেবে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। এ সময় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। নিয়মিত বর্ষণে বদলে যায় চারপাশের পরিবেশ। বর্ষার ভারি বর্ষণে শরীর ধুয়ে নেয় প্রকৃতি। বেলী, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। আর মিষ্টি হাসি হয়ে ফোটে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।’ ময়ূর পেখম মেলে নাচে।
বর্ষার অপরূপ রূপ দেখা যায় গ্রামবাংলায়। বিশেষ করে হাওড় অঞ্চলে। এ সময় বৃহত্তর সিলেট ও কিশোরগঞ্জের হাওড়ের ছবিটা আমূল বদলে যায়। গ্রীষ্মে হাওড়ের যে অংশ হাঁটার পথ, বর্ষায় তা অথৈ জলের নদী। শুকনো মৌসুমে যে জায়গায় হালচাষ করে কৃষক, ভরা বর্ষায় সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরে জেলে। বর্ষায় ভাটি অঞ্চলের বাবা-মায়েরা নৌকোয় করে তাদের মেয়েকে নাইওর আনার ব্যবস্থা করেন। সেই দৃশ্য দেখে ভাটির বাউলেরা আরও গভীরতর অনুভূতির জায়গা চলে যান। তারা গেয়ে ওঠেন- গাঙে দিয়া যায়রে কত নায়-নাইওরির নৌকা সখি রে/মায়ে-ঝিয়ে বইনে-বইনে হইতেছে যে দেখা রে...। বর্ষায় এসব অঞ্চলে বিয়ের ধুম পড়ে। নৌকো করে বরযাত্রা। বউ নিয়ে বাড়ি ফেরা, সেও নৌকোয়। এ দৃশ্যটাও অদ্ভুত সুন্দর।
প্রকৃতি পরিবেশের পাশাপাশি মানুষের হৃদয়েও নানাভাবে ক্রিয়া করে বর্ষা। মন মেঘের সঙ্গী হতে চায়। কবিগুরুর ভাষায়: মন মোর মেঘের সঙ্গী,/উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে/রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম...। বর্ষায় মন কখনো ‘ময়ূরের মতো নাচে রে।’ আবার কখনো বেদনায় বেদনায় ডুবায়। তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা...। প্রিয়জন ছাড়া যেন কাটতে চায় না দিন। কারও কারও বুকে বাজে হারানোর ব্যথা। বর্ষায় সে যন্ত্রণার কথা কথা জানিয়ে কবি লিখেন: চেনা দিনের কথা ভেজা সুবাসে,/অতীত স্মৃতি হয়ে ফিরে ফিরে আসে।/এমনি ছলছল ভরা সে-বাদরে/তোমারে পাওয়া মোর হয়েছিল সারা...। আরও বহুকাল আগে রিক্ত বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছিলেন: এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা ভাদর/মাহ ভাদর/শূন্য৬ মন্দির মোর...। এখানেই শেষ নয়, মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলেছিলেন।
এসব বিবেচনায় বিরহের ঋতু বটে বর্ষা। বাদল দিনে বিরহকাতর হয়ে ওঠা বাঙালী মনের ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে সমকালীন কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছে মহাভারতের পঞ্চপা-ব! হয়তো এ কারণেই বর্ষায় বিরহ বেড়ে যায়।
আমরা দেখি লোককবি দুর্বিন শাহ গাইছেন- প্রাণ সখিরে, আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ার, ডুবায় গাঙ্গের দুটি পাড়/খেলব সাঁতার কারে সঙ্গে লইয়া...। আর নজরুলের সেই বিখ্যাত গান তো সকল বিরহীর: শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না/বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না...। অন্যত্র প্রেমের কবি লিখেছেনÑ অথৈ জলে মাগো, মাঠ-ঘাট থৈ থৈ/আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই...।
এভাবে অসংখ্য কবিতারও জন্ম হয় বর্ষায়। বলা হয়ে থাকে, বর্ষা ঋতুতেই জীবনের প্রথম কাব্য রচনা করেন বাংলার কবিরা। পরিণত কবিও বর্ষাকে আশ্রয় করেন। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এই সাতটি জেলার লোককবিরা বর্ষা দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছেন। তাদের কালজয়ী সৃষ্টি সে কথা বলে চলেছে।
অবশ্য বর্ষার সবই উপভোগ্য উপকারের- এমনটি বলা যাবে না। ভারি বর্ষণে, পাহাড়ী ঢলে গ্রামের পর গ্রাম যে ভাসিয়ে নেয় সে-ও বর্ষা! অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার মানুষ এ সময় বন্যার আশঙ্কায় থাকে। কখনও কখনও কৃষকের ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। শাহ আবদুল করিমের ভাষায় : আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি/ গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায়/ ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না/বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায়...। একইভাবে ঝড়ে খেই হারানো জেলের নৌকোটি ঘাটে সব সময় ফিরতে পারে না! আর কর্দমাক্ত পথে পা পিছলে পড়ার গল্প তো প্রতিদিনের। বর্ষার কাছে কবিগুরুর তাই প্রার্থনা করে বলেন, এমন দিনে সকলের সবুজ সুধার ধারায় প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধারায়,/বামে রাখ ভয়ঙ্করী বন্যা মরণ-ঢালা...।
উদ্যাপন হবে অনলাইনে ॥ প্রতি বছর নানা আয়োজনে বর্ষাকে বরণ করে নেয় বাঙালী। ঢাকায় ছায়ানট, উদীচী, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠন প্রিয় ঋতুর বন্দনা করে। তবে এবার করোনার দুঃসহকালে বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ। এ কারণে চারুকলার বকুলতলায় বা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে কোন আয়োজন থাকছে না। তবে ফেসবুক লাইভে বর্ষা উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ভার্চুয়াল আয়োজনে শিল্পীরা গানে কবিতায় নাচে প্রিয় ঋতুকে স্বাগত জানাবেন।
Post a Comment